মোঃ আবদুল্লাহ আল-মামুন
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রত্নভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বান্দরবান, লামা, আলীকদম, চকরিয়া, ও নাইক্ষ্যংছড়ি এখন তামাক চাষের আগ্রাসনে এক সীমাহীন বিপর্যয়ের মুখে। এই আগ্রাসনে কৃষক, পরিবেশ, নদী, বন, এবং জনস্বাস্থ্য—সবকিছুই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়দের মতে, এই সংকট কেবল কৃষি সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়।
তামাক চাষের প্রধান শিকার হচ্ছে স্থানীয় কৃষি ও ভূমি। চুল্লি তৈরি করে তামাক শুকানোর জন্য নির্বিচারে বন ও জমি উজাড় করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। খুলনা গবেষণা কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তামাক চাষের কারণে স্থানীয় জমির উর্বরতা প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে।
স্থানীয় কৃষকরা হতাশ। দেলোয়ার হোসেন (৫০) নামের এক কৃষক জানান, “যত দিন তামাক ছিল, ঐ জমিতে আশা অনুরূপ কোন ফলন হয়নি। এখন ঋণ মেটানোও কঠিন হয়ে গেছে।” তামাক কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে কৃষকরা সাময়িক লাভের মুখ দেখলেও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির জালে জড়িয়ে পড়ছেন। কৃষি গবেষক ড. মো. সাইফুল ইসলাম সতর্ক করে বলেন, তামাক চাষের জন্য মাটির জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে।
তামাক শুকানোর চুল্লি তৈরির কারণে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ টন কাঠ ছাই হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পাহাড়ের অমূল্য বনজ সম্পদ হারাচ্ছে দেশের পরিবেশ।
অন্যদিকে, তামাক চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান ও কীটনাশক নদীর জলে মিশে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। মাতামুহুরী, সাঙ্গু ও বাঘখালি নদীসহ আশপাশের জলাশয়ে জলজ প্রাণীর সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। নদীজেলে মো. জমিরউদ্দীন বলেন, “তামাকের কীটনাশক ও রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে মিশে যায়। এখন মাছ পাওয়া খুবই দুষ্কর।” শুকনো মৌসুমের বিভিন্ন সময়ে নদীতে মরা মাছ ভেসে ওঠার ঘটনাও ঘটছে।
তামাকের রাসায়নিক পদার্থ এবং বার্নের ধোঁয়া বায়ুদূষণকে উদ্বেগজনকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. শাহিদা রহমান উল্লেখ করেছেন যে, এই বায়ুদূষণ স্থানীয় শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
খুলনা গবেষণা কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৫০% শিশু স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আক্রান্ত। স্কুলছাত্রী মাহফুজা (১২) তার কষ্টের কথা জানিয়ে বলে, “তামাকের ধোঁয়া শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়, চোখের পাতা ফোলা থাকে, খুবই অস্বস্তি বোধ করি।” শহরবাসীও শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি ক্যান্সারের মত মারাত্মক রোগের শিকার হচ্ছেন।
কৃষি গবেষক ড. মো. সাইফুল ইসলাম দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি থেকে মুক্তির জন্য বিকল্প ফসলের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি আদা, হলুদ, কফি চাষ সহ অন্যান্য লাভজনক সবজি চাষের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, তামাক চাষের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ কমানোর চেষ্টা চলছে, কিন্তু এটি পুরোপুরি বন্ধ করতে সরকারের জরুরী পদক্ষেপ প্রয়োজন। দ্রুত পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে:
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এখন সীমাহীন বিপদসীমার দিকে এগোচ্ছে। জাতির সুন্দর ভবিষ্যৎ রক্ষায় এবং পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত এই বিপর্যয় রোধ করতে সরকারের দ্রুত ও কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
মন্তব্য করুন